তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ১০ টি ব্যবহার
প্রযুক্তি এখন আমাদের জীবনের অঙ্গ। আগে যেখানে কিছু কাজ করতে অনেক সময়, শ্রম আর টাকা লাগত, এখন সেগুলোই খুব সহজে আর কম খরচে করা যায়। আপনি ভাবুন তো, আজকে আপনি সকালে ঘুম থেকে উঠে মোবাইলে খবর দেখেছেন, ব্যাংকে না গিয়ে বিকাশে টাকা পাঠিয়েছেন, আবার অফিসের কাজটাও করেছেন ল্যাপটপে বসে—সবই সম্ভব হয়েছে প্রযুক্তির কারণে। আর এই প্রযুক্তির একটি বড় অংশ হলো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। আজ আমরা এই লেখায় জানব, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) কী, এটা কোথায় কোথায় ব্যবহার হয়, আর কীভাবে এটা আমাদের জীবনকে বদলে দিয়েছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি কি?
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, যেটাকে সংক্ষেপে ICT বলা হয়, মূলত এমন এক প্রযুক্তি যার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বিনিময় এবং উপস্থাপন করা যায়। এর মধ্যে কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, টিভি, রেডিও—এই সবকিছুই চলে আসে। ICT আমাদের একে-অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সাহায্য করে, যেমন মোবাইল ফোন বা ইমেইলের মাধ্যমে। আবার, যেকোনো তথ্য যেমন খবর, আবহাওয়ার রিপোর্ট, স্বাস্থ্য পরামর্শ, শিক্ষা বা ব্যবসার ডেটা সংগ্রহ ও আদান-প্রদান করতেও কাজে লাগে।
বাংলাদেশে ICT ধীরে ধীরে কিন্তু দৃঢ় গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে। সরকার থেকে শুরু করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ এমনকি গ্রামের মানুষের কাছেও এখন ICT পৌঁছে গেছে। একটা সময় ছিল, যখন ইন্টারনেট ছিল শুধু শহরের ব্যাপার। কিন্তু এখন তো গ্রামেও মানুষ স্মার্টফোনে ইউটিউব দেখে, সরকারি সেবা নেয়, চাকরির জন্য আবেদন করে। ICT শুধুমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম না, এটা একটা উন্নয়নের হাতিয়ার, যা আমাদের সময় বাঁচায়, আয় বাড়ায় এবং নতুন নতুন সুযোগ তৈরি করে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ১০ টি ব্যবহার
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার এখন এতটাই বেড়েছে যে আমরা না চাইলেও প্রযুক্তির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। ICT শুধু অফিসে নয়, আমাদের প্রতিদিনের জীবনেও গুরুত্বপূর্ণ। নিচে ICT-এর ১০টি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলাম—
১. শিক্ষা ক্ষেত্রে
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি শিক্ষার জগতে এক বিপ্লব এনেছে। আগে যেখানে একজন শিক্ষক বোর্ডে লিখে বোঝাতেন, এখন সেখানে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে ভিডিও ও অ্যানিমেশনে ক্লাস নেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারে, ভিডিও দেখে বুঝতে পারে, অনলাইন অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে পারে। বাংলাদেশের অনেক স্কুল ও কলেজে এখন ডিজিটাল ক্লাসরুম চালু হয়েছে, যেখানে শিক্ষকরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে পড়ান। আর শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে ইউটিউব, কুরসেরা, বা অনলাইন কোচিংয়ের মাধ্যমে পড়ালেখা করতে পারে।
তাছাড়া সরকারি উদ্যোগে চালু হওয়া ‘শিখন পোর্টাল’ বা ‘মাল্টিমিডিয়া ক্লাস’ গ্রামের শিক্ষকদের হাতেও ICT পৌঁছে দিয়েছে। এক সময় ছিল, ভালো শিক্ষক বা কোচিং পেতে হলে শহরে যেতে হতো। এখন গ্রামেও শিক্ষার্থীরা ভালো মানের শিক্ষা পাচ্ছে প্রযুক্তির কল্যাণে। আবার পরীক্ষার ফলাফল অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে, ভর্তি আবেদন করা যাচ্ছে ঘরে বসে। এসব কিছুই ICT-এর সৌজন্যে।
২. স্বাস্থ্য সেবা
ICT এখন স্বাস্থ্যখাতেও এক আশীর্বাদ। টেলিমেডিসিন সার্ভিসের মাধ্যমে একজন গ্রাম্য মানুষ ঢাকার বড় ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারছেন মোবাইল বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে এখন অনলাইনে সিরিয়াল বুক করা যাচ্ছে, রোগের তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে কম্পিউটারে।
অনেক সময় দেখা যায়, একজন রোগী এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চিকিৎসা নিতে গেলে তার মেডিকেল রিপোর্ট সঙ্গে থাকে না। এখন সেই রিপোর্ট ডিজিটাল হলে, যেকোনো জায়গা থেকেই ডাক্তারেরা তা দেখতে পারছেন। আবার, স্বাস্থ্য বিষয়ক অ্যাপ যেমন ‘সাস্থ্য বাতায়ন’ বা ‘Maya’ অ্যাপের মাধ্যমে মেয়েরা গোপন স্বাস্থ্য প্রশ্ন করতে পারছে।
এছাড়া ভ্যাকসিন রেজিস্ট্রেশন, স্বাস্থ্য সচেতনতা ভিডিও, অনলাইন প্রেসক্রিপশন—এসবই ICT-এর মাধ্যমে সম্ভব হচ্ছে। তাই স্বাস্থ্যখাতে ICT এক নতুন দরজা খুলে দিয়েছে।
৩. কৃষি
বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় একটি অংশ কৃষির ওপর নির্ভর করে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এখন কৃষকদের জন্য বিশাল সহায়তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষকেরা এখন মোবাইল ফোনে আবহাওয়ার খবর জানতে পারছে, কীটনাশক বা সার কখন দিতে হবে তাও জেনে নিচ্ছে ইউটিউব বা অ্যাপ থেকে।
‘কৃষক বন্ধু’ বা ‘এসএমএস কৃষি পরামর্শ’—এই জাতীয় ডিজিটাল সেবা দিয়ে কৃষকদের হাতে প্রযুক্তি পৌঁছে গেছে। অনেকে অনলাইনে কৃষিপণ্য বিক্রি করছেন, আবার ইউটিউবে চাষাবাদের নতুন পদ্ধতি শিখছেন। এভাবে কৃষির উৎপাদন বাড়ছে, লোকসান কমছে।
এছাড়া সরকারিভাবে ডিজিটাল কৃষি প্ল্যাটফর্ম চালু করা হয়েছে, যেখানে চাষাবাদের তথ্য, রোগ নির্ণয়, দাম জানার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ICT-এর ব্যবহার কৃষকদের আধুনিক, সচেতন ও লাভজনক করেছে।
৪. ব্যবসা ও বাণিজ্য
আগে ব্যবসা মানেই দোকান, কাগজপত্র আর লেনদেন। এখন অনেক কিছুই ডিজিটাল হয়ে গেছে। একজন ব্যবসায়ী এখন ঘরে বসেই বিদেশ থেকে পণ্য আনতে পারছেন, অনলাইনে অর্ডার নিতে পারছেন। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা লেনদেন করছেন।
ই-কমার্স ব্যবসা এখন বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়। যেমন দারাজ, ফেসবুক পেজ, বা নিজস্ব ওয়েবসাইট—এসবের মাধ্যমে অনেকেই ঘরে বসে ব্যবসা শুরু করেছেন। একজন গৃহিণী এখন ঘরে রান্না করে অনলাইনে বিক্রি করছেন। ICT ব্যবসাকে সহজ, দ্রুত এবং বিশ্বজনীন করে তুলেছে।
ব্যবসায় হিসাব রাখা, গ্রাহক সম্পর্ক ব্যবস্থাপনা (CRM), অনলাইন মার্কেটিং—এসব কিছুই ICT-এর মাধ্যমে সম্ভব হচ্ছে। আর এগুলো ব্যবসার সফলতা অনেক গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
৫. সরকারি সেবা
বাংলাদেশ সরকার “ডিজিটাল বাংলাদেশ” গড়ার লক্ষ্য নিয়ে অনেক সেবা অনলাইনে এনেছে। এখন জন্মসনদ, নাগরিক সনদ, ভূমি সংক্রান্ত তথ্য, এমনকি চাকরির আবেদন পর্যন্ত অনলাইনে করা যায়। একসময় এসব কাজে অফিসে ঘুরতে হতো, এখন বাসা থেকে করা যায়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, “একসেবা পোর্টাল” বা “জেলা প্রশাসকের ওয়েবসাইট”—এসব প্ল্যাটফর্মে নাগরিকরা তাদের প্রয়োজনীয় সেবা সহজে পাচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন ডেটাবেজ যেমন জাতীয় পরিচয়পত্র, ভোটার তালিকা সবই এখন ডিজিটাল।
এসব সেবার মাধ্যমে ঘুষ কমছে, সময় বাঁচছে, আর মানুষকে অফিসে লাইন দিতে হচ্ছে না। ICT জনগণের সময় ও শ্রম দুটোই বাঁচাচ্ছে।
৬. ব্যাংকিং ও মোবাইল ফাইন্যান্স
বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিং সেবাগুলো বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিকাশ, নগদ, রকেট—এই সব মাধ্যমে টাকা পাঠানো, বিল পরিশোধ, কেনাকাটা—সব কিছুই করা যায়। ICT-এর কারণেই এই সুবিধাগুলো এসেছে।
এছাড়া ব্যাংকে না গিয়েই ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন, চেক ক্লিয়ার, অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স দেখা যায়। এটা গ্রাহকদের জন্য বিশাল সময় সাশ্রয়ী।
ব্যাংকের সফটওয়্যার এখন অটোমেটেড, যার ফলে টাকা জমা, উত্তোলন বা হিসাব রাখা সহজ হয়েছে। সাইবার নিরাপত্তাও উন্নত হয়েছে। সব কিছু মিলে ICT ব্যাংকিং সেক্টরে বড় পরিবর্তন এনেছে।
৭. চাকরি ও পেশা
আগে চাকরি খুঁজতে পত্রিকা খুঁজে বেড়াতে হতো। এখন ICT-এর কারণে ‘bdjobs’, ‘chakri.com’ বা সরকারি চাকরির পোর্টাল থেকে মানুষ অনলাইনে চাকরি খুঁজে পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ঘরে বসে ফ্রিল্যান্সিং বা অনলাইন কাজ করেও আয় করা যাচ্ছে।
গ্রাফিক ডিজাইন, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, অনুবাদ, কনটেন্ট রাইটিং—এসব কাজ এখন অনলাইনে পাওয়া যায়। অনেক তরুণ ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করে লাখ টাকা আয় করছে, যেটা ICT ছাড়া সম্ভব হতো না।
এটা শুধু শহর নয়, গ্রামেও এখন ফ্রিল্যান্সিং শেখার সুযোগ আছে। সরকারিভাবে “লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং” প্রকল্প চালু করা হয়েছে।
৮. বিনোদন
ICT আমাদের বিনোদনের জগৎকেও বদলে দিয়েছে। আগে মানুষ টিভির নির্দিষ্ট সময়ের প্রোগ্রাম দেখত। এখন চাইলে ইউটিউবে গিয়ে পছন্দমতো সিনেমা, নাটক বা গান দেখা যায়।
মোবাইল, ট্যাব বা স্মার্ট টিভিতে OTT প্ল্যাটফর্ম যেমন Netflix, Hoichoi বা Bioscope-এ বিনোদন মিলছে। ইউটিউব কনটেন্ট তৈরি করে অনেকেই আয় করছেন।
এছাড়া গেম খেলা, অনলাইন লাইভ দেখা, সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটানো—সবই ICT-এর অংশ। এটা মানুষকে ক্লান্তির পর বিনোদনের সুযোগ দিচ্ছে।
৯. পরিবহন ও ট্রাফিক
বাংলাদেশে ICT পরিবহন ব্যবস্থাকেও আধুনিক করেছে। এখন অনেক পরিবহন কোম্পানি মোবাইল অ্যাপে টিকিট বিক্রি করছে। অনলাইনে ট্রেন বা বাসের টিকিট বুক করা যায়।
ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাও উন্নত হয়েছে। সিসি ক্যামেরা, ট্রাফিক সিগনাল নিয়ন্ত্রণ সফটওয়্যার এসব ব্যবহার করে গাড়ির গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
রাইড শেয়ারিং অ্যাপ যেমন Uber, Pathao বা Shohoz মানুষকে দ্রুত ও সহজভাবে যাতায়াতে সাহায্য করছে। ICT পরিবহনে গতি ও নিরাপত্তা দুটোই বাড়িয়েছে।
১০. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। ICT এখন দুর্যোগ মোকাবেলায় কার্যকর ভূমিকা রাখছে। আবহাওয়ার সতর্ক বার্তা এখন মোবাইলে এসএমএস হিসেবে আসে, যেটা আগে ছিল না।
দুর্যোগের আগেই মানুষকে সরানো, আশ্রয়কেন্দ্র সম্পর্কে জানানো, পরবর্তী পরিস্থিতি রিপোর্ট করা—এসব সবই ICT-এর মাধ্যমে দ্রুত করা যায়।
সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন BMD, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, Red Crescent—এসব প্রতিষ্ঠান এখন ICT ব্যবহার করে তথ্য ছড়ায় এবং সাহায্য কার্যক্রম চালায়। ফলে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমে যাচ্ছে।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ
“তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ১০ টি ব্যবহার” এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-
প্রযুক্তি কি আমাদের চাকরি কেড়ে নেবে?
না, বরং প্রযুক্তি নতুন ধরনের চাকরি তৈরি করছে। তবে আমাদের নতুন দক্ষতা শেখা দরকার।
প্রযুক্তি কি শুধুই শহরের মানুষের জন্য?
না, এখন প্রযুক্তি গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। মোবাইল, ইন্টারনেট, টেলিমেডিসিন—সবই গ্রামের মানুষ ব্যবহার করছে।
উপসংহার
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আমাদের জীবনে এক নতুন অধ্যায় তৈরি করেছে। এটি শুধু আমাদের কাজকে সহজ করে দেয়নি, বরং সময়, টাকা ও শ্রম বাঁচিয়ে দিয়েছে। ICT আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা, চাকরি, বিনোদন—সবখানে উন্নতির পথে নিয়ে যাচ্ছে। “ডিজিটাল বাংলাদেশ” শুধু একটি স্লোগান নয়, বাস্তবে আমরা এখন সেই পথেই হাঁটছি। তাই ICT-কে আমরা যত ভালোভাবে জানব আর ব্যবহার করব, ততই আমাদের দেশ এগিয়ে যাবে। প্রযুক্তি এখন বিলাস নয়, এটি আমাদের প্রয়োজন।